ব্রেকিং
ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যার ৫৪ বছর
রাজধানীর রায়ের বাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ। ছবি: হারুন অর রশীদ

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিকালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে নিজের পিস্তল তুলে দিয়ে যখন আত্মসমর্পণ করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী, সেদিন ঢাকার রাস্তায় নেমে আসে হাজারো মানুষ। একের পর এক আনন্দ মিছিলে মুখরিত হয়ে ওঠে অলিগলি-রাজপথ।

কিন্তু ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই আরেকটি ঘটনা সামনে আসে, যা জাতির বিজয়ের আনন্দকে রীতিমত বিষাদে পরিণত করে দেয়। বিজয়ের পরের দিন জানা যায় যে, আত্মসমপর্ণের আগে পাকিস্তানি সেনারা পরিকল্পিতভাবে শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ শত শত বাঙালি বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে।

মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস ধরেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে হত্যা করা হয়। তবে ১৪ ডিসেম্বর রাতটি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে একযোগে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। আর ফেরা হয়নি তাদের। রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমিতে পাওয়া যায় নিথর দেহ– যেন স্বাধীনতার ঠিক আগে একটি জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার আয়োজন। জাতিকে মেধাশূন্য করার ষড়যন্ত্র।

ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যার ৫৪ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। ১৪ ডিসেম্বর এলেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মুখগুলো ভেসে ওঠে– যাদের চিন্তা, কলম, মেধা আর বিবেক ছিল একটি জাতির সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র।

পরিকল্পিত হত্যার নকশা

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের পরিকল্পনা নিয়ে আজও প্রশ্নের শেষ নেই। গবেষকদের একটি অংশ মনে করেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রভাবশালী কর্মকর্তা রাও ফরমান আলী ছিলেন এই হত্যাযজ্ঞের অন্যতম পরিকল্পনাকারী। যুদ্ধ শেষে ঢাকার গভর্নর হাউজ থেকে পাওয়া তার একটি ডায়েরিতে বহু বুদ্ধিজীবীর নাম পাওয়া যায়। যদিও পরবর্তীতে তিনি এই অভিযোগ অস্বীকার করেন।

সংখ্যার বাইরে যে গল্প

বাংলাপিডিয়ার হিসাব অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধকালে ১ হাজার ১১১ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। ঢাকায় নিহত হন ১৪৯ জন। কিন্তু ইতিহাসবিদরা বলছেন, সংখ্যার হিসাবের বাইরেও একটি বড় সত্য রয়ে গেছে। জনসংখ্যার তুলনায় ঢাকার বাইরে অনেক জেলায় বুদ্ধিজীবী মৃত্যুর হার ছিল বেশি। গ্রামাঞ্চলে শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মী, স্থানীয় সাংবাদিক– অনেকের নাম ইতিহাসের পাতায় তেমনভাবে আসেনি।

রাজশাহীর শিক্ষক মীর আব্দুল কাইয়ুমকে ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর রাতে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বাধীনতার দুই দিন পর তার মরদেহ পাওয়া যায় পদ্মার চরের গণকবরে। এমন গল্প ছড়িয়ে আছে সারা দেশজুড়ে।

কেন বুদ্ধিজীবীরাই লক্ষ্য

ইতিহাসবিদদের মতে, সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল শিক্ষাঙ্গন থেকেই। ভাষা আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান– সব ক্ষেত্রেই বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন অগ্রভাগে। মানুষকে ভাবতে শেখানো, প্রশ্ন তুলতে উদ্বুদ্ধ করা– এই কাজটাই ছিল তাদের ‘অপরাধ’। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বিশ্বাস করেছিল, দেশকে বুদ্ধিজীবীশূন্য করতে পারলে স্বাধীন বাংলাদেশ কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।

প্রধান উপদেষ্টার বাণী

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে সম্মুখসারির যোদ্ধা। শহীদ বুদ্ধিজীবীরা স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি গণতান্ত্রিক উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার।

রবিবার (১৪ ডিসেম্বর) ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ উপলক্ষে শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) দেওয়া এক বাণীতে তিনি বলেন, বুদ্ধিজীবীরা তাদের মেধা ও প্রজ্ঞার প্রয়োগ, সাংস্কৃতিক চর্চা ও ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। যুদ্ধকালীন সরকারকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও কৌশলগত পরামর্শ দিয়ে জাতিকে বিজয়ের পথে এগিয়ে নিতেও তাদের ছিল অসামান্য ভূমিকা।

রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধা ও রাজনৈতিক কর্মসূচি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আজ রবিবার সকালে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধা জানানো হবে। পরে শহীদ পরিবার, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা জানাবেন মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে।

বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী ও সামাজিক সংগঠন দিবসটি উপলক্ষে পৃথক কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এছাড়া সারা দেশে আলোচনা সভা, বিশেষ অনুষ্ঠানমালা ও ধর্মীয় প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে।