ব্রেকিং
পাকিস্তানের প্রতি ট্রাম্পের আকস্মিক ঝোঁক: ব্যক্তিগত স্বার্থে নড়ে উঠছে দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত ভারসাম্য

প্রথম প্রেসিডেন্ট মেয়াদের একেবারে শুরুতে, ২০১৮ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া প্রথম পোস্টেই পাকিস্তানকে নিয়ে তীব্র ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি লিখেছিলেন—আগের ১৫ বছরে যুক্তরাষ্ট্র ‘বোকার মতো’ পাকিস্তানকে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা দিয়েছে, আর বিনিময়ে ফেরত পেয়েছে শুধু ‘মিথ্যা আর প্রতারণা’।

এর পরপরই ‘সন্ত্রাসীদের আশ্রয়–সহযোগিতা’ দেওয়ার অভিযোগে, বিশেষ করে নাইন–ইলেভেনের প্রায় এক দশক পরও ওসামা বিন লাদেনকে ‘লুকিয়ে রাখার’ কারণে পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ মার্কিন নিরাপত্তা সহায়তা স্থগিত করেন তিনি।

পাকিস্তান আজও বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে নিরাপদ আশ্রয়, সামরিক সহায়তা এবং গোয়েন্দা সহযোগিতা দিয়ে আসছে। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে এমন এক বাস্তবতা—চীন, যা এখনো যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, সেই চীনেরই ঘনিষ্ঠ মিত্র পাকিস্তান।

তবু আশ্চর্যজনকভাবে, পাকিস্তানকে ধমকানোর বদলে ট্রাম্প প্রশাসন উল্টো ইসলামাবাদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

ওয়াশিংটনের ব্যাখ্যা—ইরানকে ঠেকানো এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে এমন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর লাগাম টেনে ধরতে পাকিস্তান নাকি ‘মূল্যবান অংশীদার’। কিন্তু পাকিস্তান বারবারই প্রমাণ করেছে নিরাপত্তা ইস্যুতে তাদের ওপর ভরসা করা যায় না। সে চরিত্র হঠাৎ বদলে গেছে এমন ভাবার কারণও নেই।

তা হলে এই ঘনিষ্ঠতার উৎস কোথায়? সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা—ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আর্থিক স্বার্থ এবং তাঁর ‘লেনদেনকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতি’ এখানে এসে মিশেছে।

এই প্রেক্ষাপটে গত এপ্রিলে ওয়ার্ল্ড লিবার্টি ফাইন্যান্সিয়ালের সঙ্গে পাকিস্তানের করা বিতর্কিত বিনিয়োগ চুক্তিটি গুরুত্বপূর্ণ। এই ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রতিষ্ঠানের বড় অংশের মালিক ট্রাম্প পরিবার। আর প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী জ্যাক উইটকফ হচ্ছেন ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের ছেলে।

এত বড় একটি চুক্তির মূল লাভ ট্রাম্প পরিবার এবং উইটকফ পরিবারের ঘরেই গিয়ে ঠেকেছে। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিকতা–বিষয়ক নজরদারি সংস্থা এবং সাবেক মার্কিন কর্মকর্তারা প্রশ্ন তুলছেন ট্রাম্পের ব্যক্তিগত ব্যবসা যেন মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করছে।

ট্রাম্প যে ব্যক্তিগত লাভকেই তাঁর পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্র করে তোলেন এই ধারণা আরও শক্তিশালী হয়েছে।

এই ব্যক্তিগত স্বার্থ–রাজনীতির মাঝেই গত জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্র–পাকিস্তান উষ্ণতা সবচেয়ে স্পষ্ট ছিল। দুই দেশ তখন জানায়, তারা একটি বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছেছে। যদিও সবকিছু প্রকাশ করা হয়নি, পাকিস্তান উচ্ছ্বসিত কারণ যুক্তরাষ্ট্র তাদের ওপর আরোপিত শুল্ক কমাচ্ছে, এবং মার্কিন বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

পাকিস্তান এখন যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে চাইছে যে, তারা গুরুত্বপূর্ণ খনিজ বিশেষ করে বিরল মাটির খনিজ সরবরাহ করতে পারে এবং এতে চীনের ওপর মার্কিন নির্ভরতা কমবে।

গত সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের সামরিক–সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠান ফ্রন্টিয়ার ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস স্ট্র্যাটেজিক মেটালস–এর সঙ্গে ৫০ কোটি ডলারের চুক্তি সই করে। এটি পাকিস্তানের কাছে কূটনৈতিক বিজয়ের মতোই।

চুক্তির পরপরই প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা ট্রাম্পকে কাঠের তৈরি আকর্ষণীয় একটি বাক্স উপহার দেন, যার ভেতরে ছিল খনিজের নমুনা। এরপর পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রে বিরল খনিজের একটি প্রতীকী চালানও পাঠায়।

কিন্তু পাকিস্তান সত্যিই কি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খনিজ সরবরাহ করতে পারবে? সেটি অত্যন্ত অনিশ্চিত।

তাদের দাবি, ৬–৮ ট্রিলিয়ন ডলারের খনিজ সম্পদ রয়েছে এটি কোনো যাচাইকৃত তথ্য নয়। আর কথিত মজুতের বড় অংশই বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখাওয়া—যেখানে বিদ্রোহের কারণে বড় আকারে খনন প্রায় অসম্ভব।

এ নিয়ে একজন বিশ্লেষকের মন্তব্যই যথাযথ, 'পাকিস্তান সোনার প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু হাতে তুলে দেয় নুড়িপাথর।' তবে ট্রাম্প এমন ‘চটকদার প্রতিশ্রুতি’ খুব সহজেই বিশ্বাস করেন—বিশেষ করে যখন তা ব্যক্তিগত তোষামোদ দিয়ে মোড়ানো।

পাকিস্তান ট্রাম্পকে এমনভাবে প্রশংসা করেছে যে তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য পর্যন্ত মনোনয়ন দিয়েছে। ফলে পাকিস্তানের প্রতি ট্রাম্পের ঝোঁক অস্বাভাবিক নয়। মনে হয়, ইসলামাবাদ ঠিক বুঝে গেছে ট্রাম্পকে সন্তুষ্ট করার কৌশল।

এ সুযোগেই পাকিস্তানের নেতারা একটি সাংবিধানিক সংশোধনী পাস করান, যাতে সেনাপ্রধান—যাকে ট্রাম্প বলেন তাঁর ‘সবচেয়ে প্রিয় ফিল্ড মার্শাল’—দেশের কার্যকর শাসক হয়ে ওঠেন। নির্বাচিত সরকার এখন কেবল একটি মুখোশমাত্র।

পাকিস্তানের প্রতি এই অকারণ স্নেহ ভারতের দৃষ্টিতে সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা। কারণ দুই দশকের সম্পর্ক–গঠনের পেছনে ছিল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মিল এবং চীনকে মোকাবিলার যৌথ লক্ষ্য।কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে কাছে টেনে ভারতের কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা স্বার্থের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিচ্ছে।

এর আগেও উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। ভারত–পাকিস্তানের তিন দিনের সামরিক সংঘর্ষ যুদ্ধবিরতিতে শেষ হওয়ার পর ট্রাম্প দাবি করেন, সংঘর্ষ থামানোর পেছনে তাঁর প্রধান ভূমিকা ছিল। ভারত তা সরাসরি অস্বীকার করে, মোদি জানান—সংঘর্ষ চলাকালে ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগই হয়নি। কিন্তু ট্রাম্প নিজের দাবিতে অনড় থাকেন।

এর ফলে ভারতের ভেতরে ধারণা তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বাস করা যায় না। মোদির অবস্থানও দুর্বল হয়। মোদির নোবেল পুরস্কার ইস্যুতে ট্রাম্পের প্রত্যাশা পূরণ না হওয়া দুই দেশের দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি বাণিজ্যযুদ্ধে গিয়ে ঠেকে।

ট্রাম্প ভারতীয় আমদানির ওপর প্রথমে ২৫ শতাংশ, পরে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেন। ভারতের কাছে এটি নিছক বাণিজ্যনীতি নয় রাজনৈতিক প্রতিশোধেরই রূপ।

ভারতের অভিযোগ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, তুরস্ক—এদের কেউই বিপুল রুশ জ্বালানি কেনার জন্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েনি। তাহলে ভারতের ওপর শুল্ক কেন?

এসব ঘটনা শুধু ভুল–বোঝাবুঝি নয় এগুলো এমন এক কৌশলগত সম্পর্ককেই ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে, যা বহু বছরের পরিশ্রমে তৈরি হয়েছে এবং যা ইন্দো–প্যাসিফিকের নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু পাকিস্তানের তোষামোদ, চটকদার উপহার আর ব্যক্তিগত লাভের প্রলোভনে ভেসে গিয়ে ট্রাম্প এখন পুরো অঞ্চলকে ঝুঁকির মাঝখানে ফেলছেন—ঠিক যেমন শীতল যুদ্ধের সময় দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবহেলা বড় ক্ষতি ডেকে এনেছিল।

  • লেখা: ব্রহ্ম চেলানি
    নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এর অধ্যাপক (অব.) এবং বার্লিনের রবার্ট বোশ একাডেমির ফেলো

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট