ব্রেকিং
ঢাকায় ৬ মাত্রার ভূমিকম্পের শঙ্কা

আন্তর্জাতিক একটি গবেষকদল নতুনভাবে একটি সক্রিয় ভূগর্ভস্থ ফাটলরেখা (ফল্টলাইন) খুঁজে পেয়েছে। ফাটলরেখাটিকে তিনটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। এর এক ভাগে স্বল্প মাত্রার, অন্য ভাগে উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে, আর তৃতীয় অংশে ভূমিকম্পের কোনো ঝুঁকি নেই। প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ফাটলরেখা বাংলাদেশের জামালপুর ও ময়মনসিংহ থেকে ভারতের কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত। গবেষকরা জানিয়েছেন, এটি সর্বোচ্চ ৬ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে সক্ষম।

সম্প্রতি গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আক্তারুল আহসান। এ কাজে যুক্ত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, তুরস্ক এবং বাংলাদেশের অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা।

আক্তারুল আহসান জানিয়েছেন, ১৪-১৯ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানায় জিওফিজিক্যাল ইউনিয়নের আয়োজনে ছয় দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ গবেষণার বিস্তারিত ফলাফল উপস্থাপন করা হবে।

তিনি বলেন, তার দল ২০২৪ সালের মার্চে ‘টেকটোনিক জিওমরফোলজি’ পদ্ধতিতে এই গবেষণা শুরু করে এবং সম্প্রতি তা শেষ হয়েছে। এ গবেষণায় একটি নতুন ফাটলরেখা শনাক্ত হয়েছে, যা তিনটি অংশে বিভক্ত। এর এক অংশে স্বল্প মাত্রার, অন্য অংশে উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকি এবং তৃতীয় অংশে ঝুঁকি নেই। তবে কোন অংশে ঝুঁকি বেশি বা কম, তা এখন প্রকাশ করা হয়নি। গবেষণার ফলাফল শিগগিরই একটি বিশ্বখ্যাত জার্নালে প্রকাশিত হবে।

বাংলাদেশে ২১ ও ২২ নভেম্বর দুই দিনে চার দফা ভূমিকপ ঘটে। এর মধ্যে ২১ নভেম্বরের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৫.৭। এতে ১০ জনের মৃত্যু হয়। এ ধরনের প্রাণহানির ঘটনা বিগত কয়েক বছরে দেখা যায়নি। ভূমিকম্পের কম্পন জনজীবনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।

গবেষকরা নতুন ফাটলরেখার সঙ্গে কয়েকটি বড় মাত্রার ভূমিকম্প এবং ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তনের সম্ভাব্য সংযোগের প্রমাণও পেয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্রহ্মপুত্রের গতিপথের পরিবর্তন এখনও চলছে।

নতুন গবেষণায় বলা হয়েছে, সম্প্রতি চিহ্নিত ফাটলরেখার জন্ম প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ বছর আগে, যা ভূতত্ত্ববিদ্যার ভাষায় ইউসিন যুগ হিসেবে পরিচিত। এরপর এটি ২ কোটি ৩০ লাখ বছর ধরে নিষ্ক্রিয় ছিল, যা মায়োসিন যুগ হিসেবে পরিচিত। পরে ৫৬ লাখ বছর আগে ইন্ডিয়ান প্লেট এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের ক্রমাগত চাপের কারণে মেঘালয়ের পর্বতমালা মাটির নিচ থেকে উঠে আসার পর ফাটলরেখা পুনরায় সক্রিয় হয়।

গবেষকরা জানিয়েছেন, ভূত্বকের অভ্যন্তরীণ চাপ বা ধাক্কা ভূমির আকৃতি ও রূপের পরিবর্তনের কারণ হয়ে থাকে। এ প্রক্রিয়াকে টেকটোনিক মরফোলজি বলা হয়। নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, ইন্ডিয়ান প্লেট প্রতিবছর প্রায় ৪৬ মিলিমিটার বা ৪.৬ সেন্টিমিটার করে ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে ঢুকছে। এই গতিপথ বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে। এটি কখনো সরাসরি উত্তর দিকে, আবার কখনো উত্তর-পূর্ব দিকে। কখনো এর গতিবেগ বেশি, কখনো কম। এই প্লেটের চলাচলের ফলে ডাউকি ফাটলসহ নতুন ফাটলরেখার সৃষ্টি হয়েছে।

ইন্ডিয়ান প্লেটের এই গতি বেঙ্গল বেসিনের আরও অনেক ফাটলের জন্ম দিয়েছে বলে জানান গবেষক আক্তারুল আহসান। তিনি বলেন, ‘এর ভেতর কিছু ফাটল ভূমিকম্প তৈরির সামর্থ্য রাখে, কিছু রাখে না। নতুন শনাক্ত ফাটলের সঙ্গে বড় মাত্রার কয়েকটি ভূমিকম্প ও ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তনের সংযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ব্রহ্মপুত্রের গতিপথের পরিবর্তন এখনো চলছে।’

নতুন শনাক্ত ফাটলরেখার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকম্পের মধ্যে ১৮৮৫ সালের ‘বেঙ্গল আর্থকোয়েক’ অন্যতম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার ২০১০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় জানিয়েছেন, ওই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৭। এর উৎসস্থল ছিল মানিকগঞ্জ। ধারণা করা হয় এটি মধুপুর ফাটলরেখার মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছিল।

এ বিষয়ে ব্রিটিশ ভূতত্ত্ববিদ চার্লস স্টুয়ার্ট মিডলম্যাসের গবেষণার বরাত দিয়ে হুমায়ুন আখতার লিখেছেন, ‘এই ভূমিকম্পের কম্পন ছড়িয়ে পড়েছিল ভারত, ভুটান ও মিয়ানমারের কিছু এলাকায়। তখন অন্তত ৭৫ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল। তাদের ৪০ জনই ছিলেন শেরপুরের। ভূমিকম্পটিতে ময়মনসিংহে বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।’

১৯২৩ সালে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ এলাকায় একটি ভূমিকম্প ঘটেছিল। ইউএসজিএসের (মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা) আর্থকোয়েক ক্যাটালগে ৬.৯ মাত্রার হিসেবে লিপিবদ্ধ। আক্তারুল আহসানের গবেষণায় উঠে এসেছে, এই ভূমিকম্পটির সঙ্গেও নতুনভাবে চিহ্নিত ফাটলরেখার সম্পর্ক রয়েছে।

নতুন গবেষণায় ‘মর্ফোলজিক্যাল চেঞ্জ’ অধ্যয়নে স্যাটেলাইট ম্যাপিং ব্যবহারে সহযোগিতা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আশরাফুল আলম। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে ভূতাত্ত্বিক বাস্তবতা হলো অনেক ফল্টলাইন বা ফাটলরেখা আছে। গবেষণা করলে এ অঞ্চলে এ রকম আরও ফাটলরেখার সন্ধান মিলবে। ফাটলরেখা থাকা মানেই উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প হবে, তা বলা যায় না।’