ব্রেকিং
রমজানের আগে সক্রিয় পুরনো সিন্ডিকেট
বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন, চালের দাম বাড়ছে চার-পাঁচ জন বড় ব্যবসায়ীর কারসাজিতে। তবে শুধু চালের বাজার নয়; পুরো ভোগ্যপণ্যের বাজারেই একাধিক সিন্ডিকেট সক্রিয়। ছবি: সংগৃহীত

দীর্ঘদিন ধরেই ঊর্ধ্বমুখী নিত্যপণ্যের বাজার। জীবন ধারণের উপযোগী প্রতিটি জিনিষের অগ্নিমূল্য। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, মাছ, মাংস, তেল, ফলমূল, চিনি, লবণসহ সবকিছুর দাম আগের তুলনায় বেড়েছে। রমজান মাস সামনে রেখে পরিকল্পিতভাবে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছে বাজারে সক্রিয় সিন্ডিকেট— এমন অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহল থেকে।

খোদ বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন, চালের দাম বাড়ছে চার-পাঁচ জন বড় ব্যবসায়ীর কারসাজিতে। তবে শুধু চালের বাজার নয়; পুরো ভোগ্যপণ্যের বাজারেই একাধিক সিন্ডিকেট সক্রিয়। কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। অথচ লাগামহীন দাম বাড়ার কারণে সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে চাকরিজীবী আর খেটে খাওয়া মেহনতী মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।

এদিকে, রমজান মাস সামনে রেখে আমদানিকৃত বিপুল পরিমাণ নিত্যপণ্য এরইমধ্যে দেশে আনা হয়েছে। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ কিংবা ঢাকার মৌলভীবাজারের মতো পাইকারি পণ্যের মার্কেটগুলো এখন ঠাসা চিনি, ছোলা, ডাল, সয়াবিন তেল, গম, খেজুর ও বিভিন্ন ধরনের মসলাসহ নানা রকম নিত্যপণ্যে।

এসব নিত্যপণ্যের বেশিরভাগ বেচাকেনা ও ব্যবহার হবে রমজান মাসে। ব্যবসায়ীরাও বলছেন, এ বছর রমজানের নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে এবারের রমজানে ভোগ্যপণ্যের সংকট হওয়ার আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এরপরেও পণ্যের দাম বাড়ছে। মাত্র দুদিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ৫ টাকা বাড়িয়ে চিনি এখন খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৯৫-১১৫ টাকা কেজি। এছাড়া গত বছরের এ সময়ের তুলনায় চাল প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। আলু ও রসুনের দাম বাড়িয়ে বাড়তি মনাফা লুটে নেয়া হচ্ছে।

ভোগ্যপণ্যের দাম কেন বাড়ছে? এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই। দায়িত্বশীলরা দোষ চাপান একে অন্যের ওপর। এ দুর্ভোগের জন্য মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের দায়ী করছেন সাধারণ মানুষ ও বাজার বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে না— সরকারের এমন ঘোষণার দুই-তিন মাস আগেই বাড়তে থাকে পণ্যমূল্য। ফলে রমজান মাসে আর পণ্যের দাম বাড়ে না। বাড়ে এর আগেই। এবারও ঠিক একই পথে হাঁটছেন ব্যবসায়ীরা।

মাত্র দুই মাস বাকি রয়েছে রমজান মাসের। এরইমধ্যে রমজান মাসকে টার্গেট করে নিত্যপণ্যের বাজারে পুরনো কৌশলে শুরু হয়েছে কারসাজি।

এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ক্যাবের পক্ষ থেকে আমরা পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে প্রতিনিয়ত বাজার মনিটরিং, দোকানে মূল্য তালিকা প্রদর্শন এবং নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছি।

বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে তিনি জানান, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো কিংবা বাজার অস্থিরতায় সব সময় একটি অসাধু ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সক্রিয় থাকে। রমজান সামনে রেখে এই চক্র বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং এটাই ঘটছে প্রতি বছর। তাই বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি হলেও বাজার অস্থির করার চেষ্টা করা হতে পারে। তবে আগাম সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া গেলে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ফায়দা লুটতে পারবে না।

রাজধানীর কাওরান বাজার, মালিবাগ কাঁচাবাজার, মতিঝিল এজিবি কলোনী কাঁচাবাজারসহ একাধিক খুচরা বাজারে শুক্রবার প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ৯৫-১১৫ টাকা। যা দুদিন আগে মঙ্গলবারও ৯০-১১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর গত বছর একই সময় তা বিক্রি হয়েছে ১৩০ টাকায়।

এদিকে মূল্যবৃদ্ধির চিত্র উঠে এসেছে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনিক পণ্যমূল্য তালিকায়। সংস্থাটি বলছে, সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি চিনির দাম বেড়েছে ২.৫০ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, নিত্যপণ্য আমদানি করতে এবার চলতি বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে সবচেয়ে বেশি হয়েছে ঋণপত্র (এলসি) খোলার পরিমাণ। এসব পণ্য রমজান মাসের আগেই দেশে পৌঁছবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রমজান সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে পণ্যের দাম বাড়বে না।

এজন্য পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর বাজার মনিটরিং এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নজরদারি বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে যারা ভোগ্যপণ্যের মজুত বাড়িয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজার অস্থিরতার চেষ্টা করবে তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, দেশে এখন চিনির কোনো ঘাটতি নেই। আমদানির শর্ত শিথিল হওয়া ও বিশ্ববাজারে দাম কমার কারণে দেশের বাজারে চিনির দাম কেজিতে ১০০ টাকার নিচে বিক্রি হচ্ছিল। প্রতি বছর রোজায় চিনির দাম বাড়ায় অসাধু সিন্ডিকেট। এবারও তা-ই করছে। বাড়াচ্ছে দাম। কারা দাম বাড়াচ্ছে— মূল্য পরিস্থিতি মনিটরিং করে তা চিহ্নিত করতে হবে।

রমজান মাসে অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে পরিচিত ছোলা, খেজুর, মটর ডালসহ ৬ ধরনের পণ্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার হার বেড়েছে। রোজায় এসব পণ্যের চাহিদা বিবেচনায় আগেভাগেই এটি করেছেন ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কোনো কোনো পণ্যের ঋণপত্র খোলার হার ১১-২৯৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ঋণপত্র খোলার পর পণ্য আসতে তিন মাস পর্যন্ত সময় লাগে। সেই অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির আগেই এসব পণ্য দেশে চলে আসার কথা।

পাশাপাশি চলতি মাসে পণ্য আমদানি করতে আরও বেশি ঋণপত্র খোলা হচ্ছে। গত বছর চিনি আমদানিতে এলসি খোলা হয়েছিল ২ লাখ ৬৪ হাজার ৪৪৬ টন। চলতি বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৯২ হাজার ৫৭২ টন। আমদানি বেড়েছে ১১ শতাংশ।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, রমজান মাসে পণ্য আমদানি নিয়ে ও মূল্য পরিশোধে কোনো শঙ্কা নেই। গত বছর রমজানে পর্যাপ্ত ফরেন এক্সচেঞ্জ দিয়ে সরবরাহ ঠিক করতে পেরেছিলাম। এবারের রমজান ঘিরে আমি এখনই বলতে পারি, কোনো শঙ্কা দেখছি না। রমজানের যেসব পণ্য আমদানি হয়, এরইমধ্যে সেগুলোর এলসি ওপেনিং হয়ে গেছে।